
আনন্দবাজারে যখন কাজ করতাম, তখন এটা হতো। সন্ধের দিকে একটু দেরিতে চা খেতে বেরোলেই হতো এমনটা। ঘড়িতে হয়তো সাড়ে আটটা থেকে ন’টা, তখন পসরা গুটিয়ে ফেলেছেন বেশির ভাগ পথ দোকানি। আর চড়িয়েছেন রান্না। সে রান্নার দৃশ্য-গন্ধ মুখন্থ হয়ে গেছিল। এক একটা ছোট ছোট দলে রান্না হতো। যেন এক একটা ছোট ছোট কমিউনিটি কিচেন! ক’টায় বেরিয়ে কোন পথে যাচ্ছি, তার ওপর নির্ভর করত রান্নার ব্যাপারটা। কোনও দল হয়তো সদ্য কড়াইয়ে ফোড়ন ফেলে আনাজ ছাড়ছে, কোনও দলের কড়াইয়ে রসিয়ে কষানো চলছে রগরগে মশলা।
কোনও দল আবার কড়াইয়ে জল ঢেলে আটা মাখতে বসেছে। কেউ আবার আচ্ছা করে শিলে পিষছে রসুন-শুকনোলঙ্কা। কী হবে? চাটনি? রুটিতে চাখনা মাখিয়ে টাকরায় শব্দ তুলে খাওয়া হবে? নাকি লাল তেল ভাসা ডিম কষায় পড়বে বলে বানা বাটা হচ্ছে! খবর নেওয়া হয়নি কখনও। কত কত মন খারাপের দিনে ইচ্ছে হয়েছে আর ফিরব না অফিসে। ফুটপাথেই ওঁদের সঙ্গে বসে পড়ব পাত পেড়ে। কখনও মনে হয়েছে, একটু গল্প করতে করতে খুন্তি নাড়ব কালো কড়াইটায়। কখনও আবার ইচ্ছে হয়েছে, কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গন্ধটা শুঁকি।
আহ্… এই জন্যই বুঝি বলে, গন্ধে অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়? এর কোনওটাই অবশ্য কখনওই করা হয়নি। দ্রুত পায়ে চা খেয়ে এসে কাজে জুতে যেতে হয়েছে। এমনটাই হয়। আর যাঁদের এমনটা হয় না, যাঁরা এ সব ইচ্ছেদের হাতে পূরণ-বেলুন বেঁধে দিতে পারেন, তাঁরা আমার মতো পাপী নন।
এত ভাল করে রান্নার গন্ধ আবার খুঁটিয়ে পরখ করলাম গতকাল রাতে, গদখালি ঘাটের চায়ের দোকানটায়। সুন্দরবন থেকে ফেরার সময়। গোসাবা থেকে নদী পেরিয়ে এসে চা খাচ্ছি যখন, চা খেয়েই রওনা দেব কলকাতার পথে, তখন দোকানের ভিতরঘরে মনে হয় সয়াবিন চেপেছিল। না-ও হতে পারে, অন্য কোনও রান্নাও হতে পারে, আবার সয়াবিনও হতে পারে।

কাল মন্মথনগর নামের ছোট্ট দ্বীপটায় পৌঁছে যখন শুনেছিলাম, কোনও সরকারি দল বা কোনও সংবাদমাধ্যম কেউ এখনও এসে পৌঁছয়নি এতটা জল ভেঙে, মিথ্যে বলব না, মুহূর্তের জন্য চমকে উঠেছিলাম আমি। এক ভাল লাগার মতো চমক। কিন্তু এই ভাল লাগার নাম কখনওই তৃপ্তি নয়, এই ভাললাগার নাম হয়তো বিস্ময়। যে বিস্ময় ধাক্কার উপর আরও জোরালো একটা ধাক্কা দিয়ে বোঝায়, সত্যিই ঠিক কতটা বিপদে মানুষ। সত্যিই ঠিক কতটা দূরে আছে বিপদে পড়া মানুষগুলো!
নিস্তব্ধ, সুমগ্ন দ্বীপের বুকে ডুবে থাকা বেগুন খেতে সূর্যের আলো ঝলসাচ্ছে। জলটা কালো হয়ে পচে, রামধনু-রঙা হয়ে গেছে। সুপুষ্ট বেগুনগুলো বেঁচে তখনও। আর দুয়েক দিনেই হাটের পসরায় জ্বলজ্বল করার কথা ছিল, তার বদলে প্রকৃতির সৃষ্টিকে পচিয়ে-গলিয়ে নষ্ট করবে প্রকৃতিই। আচ্ছা, এটাই কি প্রকৃতির প্রতিশোধ? চাল-ডাল রয়ে গেছে বহু মানুষের ঘরে, কিন্তু ডুবে গেছে জ্বলার উনুন, ভেসে গেছে রাঁধার বাসন। চাল-ডালগুলো যেন হাসছে মানুষের দিকে তাকিয়ে। এটাই কি প্রকৃতির পরিহাস? প্রতিশোধ আর পরিহাসে এমনি করেই কি ধীরে ধীরে…..

আমায় এই প্রতিশোধ আর পরিহাস নিয়ে একটু ভাবতে হয় কেবল। এই ফাঁসে পড়ে ছটফট করতে হয় না এখনও। এসব এখনও প্রত্যক্ষ ভাবে ছোঁয়নি আমায়। ঝাঁকিয়ে দেয়নি। পরোক্ষ ভাবে যেটুকু ছুঁয়েছে, তা দিয়ে আমার জীবন ব্যাহত হয়নি। আমার, খাওয়া, ঘুম, স্নান, কাজ, ফোন– কিচ্ছুতে কিছু অসুবিধা হয়নি। তাই আমরা আসলে যতই মনে করার চেষ্টা করি যে আমরা তাঁদেরই একজন, এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ভারে আমাদেরও কাঁধটুকু আছে– তা আদতে সত্যি নয়। সত্যি হলেও, তা সাময়িক।
ঠিক যেমন সাময়িক ওই রান্নার গন্ধগুলোর প্রতি আমাদের তীব্র ভাললাগাটাও। গন্ধে-বর্ণে-সম্ভাব্য স্বাদের কল্পনায় আমরা যতটা মুগ্ধ থাকি, রোজ খাবার পাতে কি সত্যিই ততটা থাকতে পারব? এই গরিব-বিলাসী মন নিয়ে কি আদৌ কিছু করে উঠতে পারব আমরা? এত খিদে-এত মৃত্যু, মানুষের জীবনের এই নিম্নমুখী দাম, এত অনিত্য বেঁচে থাকা– এ দায় কি সত্যিই নেওয়া যায়?

যায় না। চেষ্টা করা যায় হয়তো কেবল। সে চেষ্টাই চারদিকে হচ্ছে। দু’দফা রেইকির পরে টিম লাইটহাউস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাইক্লোন বিধ্বস্ত কিছু এলাকায় কাজ করবে। ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ প্রাথমিক ভাবে হলেও, ত্রাণ পৌঁছে দেওয়াটাই শুধু নয়। কারণ ইমিডিয়েট ত্রাণ ইমিডিয়েট খিদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের রিলিফটুকু দিলেও এবং তা অত্যন্ত কার্যকর হলেও, এই বীভৎস বিপর্যয়ের ব্যাপকতা ও গভীরতার কাছে তা হয়তো যথেষ্ট হবে না।
আমার এমনটাই মনে হয়েছে। তদুপরি, একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় ত্রাণের জোগান কখনও অনন্ত হতে পারে না। অনন্ত হয় কেবল ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই, যে লড়াই প্রান্তিক মানুষগুলি চিরকাল লড়ে চলেছেন। আজ এই উমফান-বিপর্যয়ই প্রথমতম লড়াই নয় তাঁদের, কিন্তু কঠিনতম বটে।
সে কঠিনে তীব্রভাবে সামিল হওয়ার দিন এসেছে। পানীয় জল, চাষের জমি, পাকা ঘর– এগুলো ফিরে না পেলে সুন্দর-মানুষদের বড় বিপদ। এ বিপদে পাশে থাকব আমরা।
পাশে থাকবেন, ভাল থাকবেন।
তিয়াষ এর কলমে
LIGHT HOUSE -Think different পাশে আছে । আপনারাও আছেন জানি